ধামরাইয়ের ঐতিহাসিক শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রা উৎসব এর বর্ণিল ইতিহাস

{"remix_data":[],"remix_entry_point":"challenges","source_tags":["local"],"origin":"unknown","total_draw_time":0,"total_draw_actions":0,"layers_used":0,"brushes_used":0,"photos_added":0,"total_editor_actions":{},"tools_used":{},"is_sticker":false,"edited_since_last_sticker_save":false,"containsFTESticker":false}
রনজিত কুমার পাল (বাবু):
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা উৎসব বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে ঢাকা জেলার ধামরাইয়ে শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রা উৎসব। উক্ত রথযাত্রা উৎসবে লক্ষাধিক পূর্ণার্থী ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটে এবং রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে মাসব্যাপী রথমেলা চলে ধারাবাহিক ভাবে।
ধামরাই শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রার বর্ণিল ইতিহাস –
রাজা যশো পাল একদা হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতে যান ধামরাই এলাকার পাশের গ্রামে। রাস্তায় চলতে চলতে হাতি একটি মাটির ঢিবির সামনে গেলে হাতিটি থেমে যায় আর চলতে চায় না।
রাজা শত চেষ্টা করেও হাতিটিকে সামনে নিতে পারলেন না এবং অবাক হলেন। তখন তিনি হাতি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজনকে ওই মাটির ঢিবি খনন করার জন্য নির্দেশ দেন। সেখানে একটি মন্দির পাওয়া যায়।
এছাড়া কতগুলো মূর্তি পাওয়া যায়। এর মধ্যে শ্রীবিষ্ণুর মূর্তির মতো শ্রীমাধব মূর্তিও ছিল। রাজা ভক্তি করে সেগুলো সঙ্গে নিয়ে আসেন। পরে ধামরাই সদরে ঠাকুরবাড়ি পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রীরামজীবন রায়কে তিনি ওই মাধব মূর্তি নির্মাণের দায়িত্ব দেন।
তখন থেকে শ্রীমাধবের নামের সঙ্গে রাজা যশোপালের নামটি যুক্ত করায় বিগ্রহের নতুন নাম হয় শ্রীশ্রী যশোমাধব। সেদিন থেকে সেবা পূজার বন্দোবস্ত হয়। আজও ধামরাইয়ে শ্রীমাধব-অঙ্গনে পূজা-অর্চনা চলে আসছে। পরবর্তীকালে শ্রীমাধবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা ও মেলা।
সুদীর্ঘ ৩৫০ বছর ধরে এ রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। কবে, কিভাবে এই বাঁশের রথটি কাঠের রথে পরিণত হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে এখানে চারটি রথ তৈরি করেন। ১৩৪৪ সালে রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের স্বর্গীয় সূর্য নারায়ণ সাহা। এ রথ তৈরি করতে সময় লাগে এক বছর।
ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিঙ্গাইর থানার বিভিন্ন কাঠশিল্পী যৌথভাবে নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করে ৬০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি তৈরি করেন। এ রথটি ত্রিতলবিশিষ্ট ছিল, যার ১ম ও ২য় তলায় চার কোণে চারটি প্রকোষ্ঠ ও তৃতীয় তলায় একটি প্রকোষ্ঠ ছিল।
মূলত রথযাত্রা দেবতা জগন্নাথদেবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন উপলক্ষে হয়ে থাকে এবং একই তিথিতে হয়ে থাকে রথটান। কিন্তু ধামরাইয়ের রথযাত্রা যশোমাধব উপলক্ষে ওই তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
রথ টানার সময় হাজার হাজার নর-নারীর উলুধ্বনির মাধ্যমে এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যদিও আজ সেই বড় রথটি আর নেই। ছোট আকারের রথ তৈরি করা হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী বড় রথটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা পুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয়া হলেও এর উৎসব-আয়োজন থেকে মানুষকে বিরত রাখা যায়নি|
৪০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দির বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই মন্দিরকে ঘিরে রথযাত্রা উৎসব ও মেলা চলছে।
ধামরাই মৌজার যাত্রাবাড়ী এলাকায় মাধবের দ্বিতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে যশোমাধবের নামে ১৬৭ শতাংশ জমি রয়েছে।
ধর্মীয় রীতি নীতি অনুসরন করে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু।ভোর সকালে ভারতেশ্বরী হোমসের শিল্পীদের ভোর-আরতি ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতের সুরে মাধবকে জাগরন করে মন্দিরের দ্বার উন্মোচন করা হয়।
রথোৎসব–মহামিলন। ধর্ম,বর্ণ শ্রেণী পেশা,ধনী,গরীব নির্বিশষে রথের রশি ধরে টানছেন,আনন্দ বিনিময় করছেন, এই সাম্যই রথযাত্রার মূল শিক্ষা।
ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রার ইতিহাস থেকে জানা যায়,বাংলা ১০৭৯ সালে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১২৫ বছর পর্যন্ত রথযাত্রা চলে এসেছে।তারপর বালিয়াটি জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রথযাত্রা অব্যাহত থেকেছে, আরও ১৪৬ বছর। বাংলা ১৩৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের পর মির্জাপুরের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা এগিয়ে আসেন রথযাত্রার উৎসব আয়োজন যা আজও অব্যাহত আছে। তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরী শ্রী রাজীব প্রসাদ সাহা,স্হানীয় গণমান্য ব্যাক্তি এবং শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির কমিটির সহযোগিতায় শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের সেবা ও রথ পরিচালনায় দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করে যাচ্ছেন।
বিকেল ৪টায় মাধব মন্দির থেকে মাধব বিগ্রহসহ অন্যান্য বিগ্রহগুলি নিয়ে এসে সারাবছর যেখানে রথটি থাকে সেই রথ খোলায়,রথের উপর মূর্তিগুলি স্থাপন করা হবে। এর পর বিকেল সাড়ে ৪ টায় রথের শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান রথ খোলায় অস্থায়ী স্থাপিত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে। এই অনুষ্ঠানের আলোচানা সভা শেষে প্রধান অতিথি রথ উৎসবের পুরোহিত হাতে প্রতিকী রশি প্রদানের মাধ্যমে রথ টানার আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করবেন। এই রথটি মূর্তি সমেত লাখো ভক্ত নর-নারী পাটের রশি ধরে কায়েত পাড়ার রথ খোলা থেকে প্রধান সড়ক দিয়ে টেনে পৌর এলাকার গোপনগরে। এখানেই রথটি প্রতিবছরের ন্যায় ৯ দিন অবস্থান করবে।
(উল্টো রথযাত্রা উৎসব)পূর্বের ন্যায় মাধব ও অন্যান্য দেব-দেবী বিগ্রহ রথে চড়িয়ে, বিকেল ৬ টায় টেনে আনবে পূর্বের স্থান ধামরাই পৌর এলাকার কায়েতপাড়াস্থ রথখোলায়। এখান থেকে মূর্তি গুলি চলে যাবে পুরোনো মাধবের নিজ আলয় মন্দিরে। রথ খোলায় রথটি সারা বছর থাকে বলে এই স্থানটির নামকরণ হয়েছে রথ খোলা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা শত শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী গগনচুম্বী দেবদেবীর কারুকার্য খচিত আকর্ষণীয় ৭৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৪৪ ফুট পাশে মুল্যবান কাঠের দর্শনীয় রথ খানা পুড়িয়ে দিয়ে বাঙালীর উৎসব ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেয়। রণদা প্রসাদ সাহাও সপুত্র প্রাণ হারিয়েছেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে রণদা প্রসাদ সাহার সুযোগ্য কন্যা শ্রীমতি জয়াপতি স্হানীয় সমাজসেবী ঠাকুর গোপাল বণিক প্রমুখ এর সহায়তায় রথযাত্রা শুরু করেন। সেটি ছিল বাঁশের রথ।পরে ১৯৭৬সালে সংশ্লিষ্ট সবার, অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত হয় কাঠের রথ।তা দিয়েই চলে আসছিল বাৎসরিক রথযাত্রা উৎসব।
পরবর্তিতে ২০০৬ সালে ধামরাইয়ের রথ উৎসবে তৎকালীন মাধব মন্দির।
কমিটির সাধারন সম্পাদক ধামরাইয়ের বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বনিকের আমন্ত্রনে রথ উৎসবে বিশেষ অতিথি হয়ে আসেন ঐ সময়ের বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রীমতি বিনা সিক্রী। ধামরাই বাসীর আন্তরিক দাবীর প্রেক্ষিতে শ্রীমতি বিনা সিক্রী তার ভাষনে পূর্বের আদলে ৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক পুড়িয়ে দেওয়া রথটির আদলেই ধামরাইয়ের রথটি নির্মান করে দেবার আশ্বাস দেন। এর পর রথ ও মাধব মন্দির কমিটির দুই জন কর্মকর্তা বর্তমান প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বণিক ও সুকান্ত বণিক ধামরাই থেকে ভারতের পুরিতে যান। সেখানেই রথ নির্মান খরচ বিষয়ক তত্বাবধায়ক বিষয়ে আলোচনা হয়।
পর্যায়ক্রমে ২০০৯ সালে তৎকালীন ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী এবং শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি-মেজর জেনারেল জীবন কানাই দাস একটি চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করেন।প্রায় এক বছরেরও অধিক সময় ধরে চলে রথের নকশা প্রণয়ণ এবং নির্মান কার্য সম্পাদন। এই কাজ যৌথভাবে সম্পন্ন করেছে UDC এবং Calvin Tecno Touch কোম্পানিদ্বয়। অবশেষে এই রথটি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মন্দির কমিটিকে হস্তান্তর করা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে ৩৭ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মনোরম এই রথটিই বর্তমান বিশ্বে সর্ববৃহৎ রথ। উক্ত রথ দিয়েই ২০১০ সাল থেকে শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথোৎসব উদযাপন করা হচ্ছে। রথ মেলাকে সফল করার জন্য রথ পরিচালনা কমিটির পাশাপাশি প্রসাশনের পক্ষ থেকে বহু সংখ্যক পুলিশ,র্যাব, বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা পোষাক ও সাদা পোষাক নজরদারী রাখে।
এবার রথযাত্রা উৎসব শুরু হচ্ছে ২৭ জুন রোজ শুক্রবার, রথযাত্রা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, মানণীয় উপদেষ্টা,
স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ঢাকা জেলা প্রশাসক, এসপি মহোদয়,উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ধামরাই থানার অফিসার ইনচার্জ।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করবেন শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির ও রথযাত্রা উৎসব পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব:) জীবন কানাই দাস, সঞ্চালনা করবেন শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির ও রথযাত্রা উৎসব পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী রাজীব প্রসাদ সাহা।
উল্টো রথযাত্রা উৎসব হবে ৫ জুলাই রোজ শনিবার। রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে রথমেলা চলবে প্রায় একমাস।