বিজয় সরকার, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
কিশোরগঞ্জ শহরের ঈশা খাঁন রোডের পাশে কোটি কোটি মানুষের শৈশব কৈশোরে মধুর স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে রথখোলার কয়েকটি জায়গা। সবগুলো সুন্দর জায়গাই হারিয়ে গেছে।
বিরাজ বাবুর পুকুরঃ একসময়ের চারআনির জমিদারের উত্তরসূরী বাবু বিরাজ মোহন রায়ের জমিদারবাড়ীর সামনের এই বিশাল পুকুর ছিল রথখোলার অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিদিন ভোর হতে গভীর রাত অব্দি শত শত মানুষ এখানে স্নান গোসল করতো, সাঁতার কাঁটতো। কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের প্রয়োজনীয় পানি এখান থেকেই সংগ্রহ করা হতো। এই পুকুর এখন অযত্নে অবহেলায় কচুরিপানা আর ময়লা আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে পাশাপাশি পুকুরের চারপাশ দখল হয়ে যাচ্ছে।
রথখোলা ময়দানঃ এটিকে ঐতিহাসিক ময়দান বলা হয়। শহরের সব সাধারণ রাজনৈতিক সভা সমাবেশ এই মাঠেই হতো। এখানে ৭০ ও ৮০ দশকে সকল দলেরই জাতীয় নেতাদের বক্তৃতা শুনেছি। খেলাধুলার জন্য, বিশেষ করে ভলিবল খেলার জন্য মাঠটি একসময় বিখ্যাত ছিল। এছাড়াও সারা বছর বাচ্চাদের খেলাধুলা, সার্কাস, পুজার মণ্ডপ, ঝুলন মেলার জন্য এটা খুব জনপ্রিয় একটা জায়গা ছিল। এখন এই মাঠের তিনদিকে নানা ধরনের দোকানপাট তৈরি হওয়াতে মাঠের প্রায় মৃত্যু ঘটেছে।
বিরাজ বাবুর মাঠ ও মন্দিরঃ সাবেক জমিদারের বিশাল বাড়ির সামনের মাঠটিতেও ছোটবেলায় খেলাধুলা আর কৈশোরে হাজার হাজার মানুষ আড্ডায় সময় কাটিয়েছে। জমিদারবাড়ীর মূল অংশে ছিল রাধানাথ জিউ জয়তি, পুজার মণ্ডপ ও সামনের বিশাল মাঠ। মূল বাড়ির ভিতরেও ছিল বিশাল উঠান। এই মাঠটির সামনের ফটকটি ছিল জমিদার বাড়ির আভিজাত্যের প্রতীক আর সামনের বাউন্ডারি ছিল লোহার গ্রীল দেয়া। এটা ছিল খুবই সুন্দর সময় কাটানোর জায়গা। ঝুলনযাত্রা আর রথযাত্রা এবং মেলার প্রধান স্থানও ছিল এই জায়গা।
এই জমিদারবাড়ির দাদারা (বিরাজ বাবুর ছেলেরা) এখানে আড্ডা দেওয়া আর খেলাধুলা করা বেশি পছন্দ না করলেও বাঁধাও দিতেন না। এই মাঠটিরও মৃত্যু ঘটেছে। বিরাজ বাবুর তিন সন্তানেরর (প্রদীপ, ত্রিদীপ, সন্দ্বীপ) মৃত্যুর পর হঠাৎ করে বিরাজ বাবুর বিশাল বাড়ির সিংহভাগ বিভিন্ন মালিকের দখলে চলে এসেছে এবং তারা এই সম্পত্তি খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলেছে।
মানসী সিনেমা হলঃ বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের বিখ্যাত সিনেমা হল। সেখানে গিয়ে অনেকই জীবনের প্রথম সিনেমা দেখেছেন। এলাকাটা সবসময় সরগরম থাকতো এই সিনেমা হলের আশেপাশের জায়গা। বিরাজ বাবুদের পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস এই সিনেমা হলটিই ছিল বলে মনে করা হয়। হলটি এখন বন্ধ এবং এখনো বিবর্ণ স্মৃতি হিসাবে টিকে আছে।
এই চারটি জায়গাই ছিল সাবেক চারআনির জমিদারের উত্তরসূরী বিরাজ বাবুর মালিকানায় । বিরাজ বাবুর জীবৎকালে এগুলো খুব গোছানো ছিল। তার বিশাল সম্পত্তির কিছু অংশ ছিল দেবোত্তর, বাকীটা পারিবারিক। উনার তিন সন্তানের মৃত্যুর পর সম্পত্তি নানা মালিকের মালিকানায় চলে গেছে, কিন্তু স্থানগুলির রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। সময়ের সাথে সবগুলো জায়গাই আকর্ষণ হারিয়েছে। পৌরসভা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষও এগুলো সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা করেনি।
নরসুন্দা নদঃ কিশোরগঞ্জ শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদ ছিল কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণ যার দুপাশে মূল শহর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বর্ষার পানিভর্তি এই নদীতে আবার শীতে বোরোধান চাষ করা হতো। এটা ছিল অনেকটা হাওরের মতো। বর্ষাকালে বড় বড় নৌকা মালপত্র নিয়ে চলাচল করতো। এই নদীতেও বর্ষায় প্রচুর সাঁতার কেটেছে ও কলাগাছের ভেলা আর ছোট নৌকায় করে অনেক ঘুরেছে হাজার হাজার মানুষ। নদী এখন অনেক প্রভাবশালীর দখলে চলে গেছে। আবার লেকসিটি তৈরির প্রকল্প নিয়ে এটাকে কচুরিপানা আর আবর্জনার ডাস্টবিন বানানো হয়েছে। নদীর মৃত্যু ঘটেছে আর মশার বিশাল প্রজননক্ষেত্র হয়েছে। এটাই আজকের উন্নয়ন। এটি দেখার জন্যও কেউ নাই।।