মাইনুল ইসলাম রাজু, বরগুনা থেকে:
আমতলী পৌরসভার বর্জ্যের বিষে পায়রা ও বাসুগী নদীর পানিতে মিশে যাওয়ায় নদীর পানি দূষিত হওয়ায় নদীতীরবর্তী মানুষের জনস্বাস্থ্য এখন মারাত্মক হুমকির মুখে পরেছে। আমতলী পৌরসভার বর্জ্য ব্যস্থাপনা কেন্দ্র না থাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সংলগ্ন ব্লকে পায়রা নদীর তীর ঘেষে এবং পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মাছ বাজারের পশ্চিম পাসে বাসুগী খালের পাড়ে বর্জ্য ফালানোর ফলে তা নদীর পানিতে মিশে যাওয়ার কারনে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
আমতলী পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে আমতলী পৌরসভা স্থাপতি হয়। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ৪ মাস তৎকালীন আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র দে পৌর প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালের ৫ মে থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে পৌরসভাটি তৃতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত হয়। পৌরসভা স্থাপনের পর ২৬টি বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পৌরসভার বাসা বাড়ি এবং হাটবাজার ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল বর্জ্য অপসারন করে তা ফালানোর জন্য নির্দিষ্ট কোন স্থান গড়ে তোলা হয়নি। ফলে বাসা বাড়ির বর্জ্য বাসিন্দারা যে যে ভাবে পারছে ডোবা নালা সড়কের আশপাশে ফেলছেন।
অন্য দিকে পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীরারা যতটুকু পারছেন হাসপাতাল এবং বিভিন্ন স্থানের বর্জ্য সংগ্রহ করে করে পৌরসভার এক নম্বও ওয়ার্ডে অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের পশ্চিম পাশে পায়রা নদী এবং পাঁচ নম্ব ওয়ার্ডের বাসুগী খালের তীর ঘেষে ফালানো হচ্ছে। বাসুগী খালটি পায়রা নদীর সাথে সংযুক্ত। বাসুগী এবং পায়রা নদীর তীর ঘেষে বর্জ্য ফালানোর কারনে তা পশুপাখি এবং কুকুরের ঘাটাঘাটিতে অধিকাংশ বর্জ্য এখন পায়রা নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে। পৌরসভার বিষাক্ত এবং ক্লিনিক্যাল বর্জ্য পায়রা নদীতে ছড়িয়ে পরায় কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুরে পানি এখন বিষে পরিনত হয়েছে। নদী তীরবর্তী এবং আশপাশের বাসিন্দারা বিষাক্ত পানি দিয়ে গোসল, রান্নাসহ নিত্য দিনের কাজে ব্যবহার করায় তাদেও শরীরে চর্মরোগ সহ নানা রোগব্যাধি দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে বর্জ্যের বিষের প্রভাবে পানি নষ্ট হওয়ায় পায়রা নদীর মাছের উপরের এর বিরুপ প্রভাব পরেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র না থাকায় একদিকে পায়রার পানি বিষাক্ত হচ্ছে অন্যদিকে শহরের অধিকাংশ ডোবানালা কিংবা সড়কের আশপাশে ময়লা ফালানোর কারনে পুরো শহর যেন ময়লার ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে।
সোমবার সকালে শরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পায়রা ও বাসুগী নদীর তীর ঘেষে ফালানো বর্জ্যের পলিথিন, চিপস, বিষ্কুটের খোসাসহ নানা ধরনে ময়লা নদীর পানিতে মিষে যাচ্ছে। তীর ঘেষে হাজার হাজার পলিথিন ভেসে বেড়াচ্ছে। মাটিতে পরে আছে হাসপাতালে ব্যহৃত শিরিজ্ঞ, কাচের বোতলসহ নানা ধরনের ক্লিনিক্যাল বর্জ্য। শহর ঘুরেও দেখা গেছে একই চিত্র। ছয় নম্বর ওয়ার্ডের কৃষি রেডির পূর্ব পাশের ডোবা, সাত ধারা, খোন্তাকাটা, সবুজবাগ, একেস্কুলসহ বিভিন্ন স্থানের সড়কের পাশে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের বাসা বাড়ী এবং দোকান পাটের নানা ধরনের বর্জ্য ফালানোর কারনে এসব এলাকা এখন ময়লার ভাগারে পরিনত হয়েছে। কুকুর বেড়াল পশুপাখির খাবার খোজার কারনে এসকল ময়লা সড়ক সহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিনিয়ত দুর্গন্দ্ধ ছড়াচ্ছে।
পায়রা নদী তীরবর্তী গাছ বাজারের বাসিন্দা রাবেয়া ও হনুফা বেগম বলেন, গাঙ্গের পানি দিয়া মোরা নাওয়া রান্দাসহ সব কাজ হরি। পানি নষ্ট অইয়া যাওয়ায় নাওনের পর গা খালি চুলকায়।
পায়রা নদীতে এক সময় প্রচুর পরিমানে ইলিশ, পাঙ্গাশ, পোয়া, তপসী, গলদা চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতে। বর্জ্যের বিষাক্ত ছোবলে মাছের বংশ বিস্তার করতে না পারায় এখন আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। অনেক জেলে মাছ না পেয়ে হতাস হয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন।
লঞ্চঘাট এলাকার জেলে রাজু খাঁ ও নিজাম খাঁ বলেন, আগের মত এহন আর মাছ পাই না। পানি নষ্ট অইয়া যাওয়ায় মাছ বেশি অয় না। বর্তমানে পায়রা গাঙ্গে ইলিশ, পাঙ্গাস ও তপসী মাছ প্রায় নাই বললেই চলে।
বরশী দিয়ে মাছ ধরা জেলে জামাল সর্দার বলেন, বরি (বরশি) দিয়া আগে ব্যামালা তপসী, পাঙ্গা পাইতাম এহন হেই মাছ শ্যাষ অইয়া গ্যাছে। হারাদিন বরি বাইলেও মাছ পাওয়া যায়না।
আমতলী পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমতলী সরকারী কলেজের সহকারী প্রফেসর (অব:) আনোয়ার হোসেন আকন বলেন, জনস্বার্থে অতিদ্রুত আমতলী পৌরসভার যে কোন স্থানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র নির্মান করা প্রয়োজন। তা না হলে পৌরসভা মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। এবং মানুষের মধ্যে চর্মরোগসহ নানা রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে।
আমতলী পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশিদ বলেন, বর্জ্যব্যবস্থাপনা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারের নিকট বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল টাকা না পাওয়ায় সে প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়।
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. চিন্ময় হাওলাদার বলেন, দূষিত পানি ব্যবহার করলে ডায়রিয়া, টাইফয়েড এবং চর্মরোগসহ পানিবাহিত পেটের নানা ধরনের পীড়া দেখা দিতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বরগুনার সহকারী পরিচালক হায়াত মাহমুদ রকিব বলেন, নদীর পানি এবং পরিবেশ রোধে আমতলী পৌরসভাকে চিঠি দেওয়া হবে এবং বর্জ্যব্যবস্থাপনা কেন্দ্র স্থাপন কওে সেখানে ময়লা ফালানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে।
আমতলী পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, পৌরসভায় একটি বর্জ্যব্যস্থাপনা কেন্দ্র অতি জরুরী ভিত্তিতে স্থাপন করা প্রয়োজন। এজন্য সরকারের নিকট জমি ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এবং একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হয়েছে। টাকা টাকা পাওয়া গেলে কাজ শুরু করা হবে।