চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে স্বাধীন সাংবাদিকতা। গত ১৫ বছরে সাংবাদিকতার হালচাল কারো অজানা নয়। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে সেটার কিছুটা হয়তো পরিবর্তন হয়েছে। তবে সাংবাদিকতার বা সাংবাদ পত্রের স্বাধীনতা কতটুকু পরিলক্ষিত হয়েছে? গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর কথা উঠেছে গণমাধ্যমের সংস্কার নিয়ে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও নিয়ে আলোচনা সমলোচনা একেবারে কম হয়নি।
বর্তমানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যেমন গণমাধ্যমগুলো সরব, গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও যদি তারা একইভাবে সরব থাকত তাহলে হয়তো দেশের আজ এ পরিস্থিতীর মধ্যে পড়তে হতোনা। গত ১৫ বছরে গণমাধ্যমের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিছু দলীয় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকের রাতারাতি ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্ত নিরেপেক্ষ ও প্রকৃত সাংবাদিকদের ভাগ্য যেন নিন্ম গতিতে বিরাজমান।
অর্থের অভাবে অনেক পত্রিকা এখন বন্ধের পথে। অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এক শ্রেনীর দালালরা সাংবাদিকদের জন্য অনুদানের অর্থ লুটপাট করেছে। কিছু গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের কারনে গণতন্ত্রের পথ হয়েছে উল্টোরথ। তখন অধিকাংশ গণমাধ্যমই উন্নয়নের জয়গান গেয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের উচ্চরব তেমনটা শোনা যায়নি। কিন্ত সেই সব গণমাধ্যম এখন সুর পাল্টে তাদের অগের চরিত্রে রয়েছে। আমি বলবো সাংবাদিক হিসেবে গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের শোষণমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার দায় ও দায়ীত্ব ভুলে গেলে চলবে না। বর্তমান পরিস্থিতী দেখলে বুঝা যায়,পেশাদার সাংবাদিকতার নীতি কার্যকর থাকছে না। কার্যকর থাকছে না সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সত্য, মানুষের অধিকার, জনস্বার্থ, সামষ্টিক মঙ্গল, দুর্নীতি উন্মোচন, ন্যায়বিচারের সংগ্রাম, সমতা, ন্যায্যতা, ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের মতো ধারণাগুলো। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতায় আনার যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গণমাধ্যম পালন করে, তা উধাও হয়ে যাচ্ছে। আর এর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ধারণা। গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় গণমাধ্যম কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
একসঙ্গে স্বৈরতন্ত্রের আইন ও যে বিধিনিষেধ আছে সেগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ১৯৯০-এ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেটার সুফলটা মনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। যতোটুকু সুযোগ আছে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হবে। স্বাধীন গণমাধ্যমের ধারণার ওপর বিভিন্ন মহল থেকে হুমকি আসে। তার মধ্যে আছে সরকার, বিজ্ঞাপনদাতা, মালিকপক্ষ এবং এমনকি সাংবাদিকদের নিজেদের নৈতিক মান ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতাও। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট সব আইন নিপীড়ন বা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত। সাংবাদিক, সংবাদপত্র অথবা সার্বিকভাবে গণমাধ্যমকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে অথবা এর মূল উদ্দেশ্যকে সহায়তা করার জন্যে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের পুলিশি হয়রানি বা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিকারের জন্যে আমাদের সংবিধানে তথ্য অধিকার আইন (আরটিআই) ছাড়া আর কোনো আইন নেই বললে ভুল হবে না।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক মানবাধিকার। আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ বা মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে নাগরিকদের এ অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এগুলো আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য। একই অনুচ্ছেদে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে: “প্রত্যেকের মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে; এই অধিকারে হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রাখা, এবং কোনও গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য ও ধারণাগুলি অনুসন্ধান করা, গ্রহণ এবং গ্রহণের স্বাধীনতার সীমানা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত”। সুইডেন বিশ্বের প্রথম দেশ যেটি ১৭৬৬ সালের ফ্রিডম অফ প্রেস অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রেসের স্বাধীনতাকে তাদের সংবিধানে সংরক্ষণ করেছিল । গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারাও সুরক্ষিত। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই অধিকার সীমাবদ্ধ করা যায় না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের সংবিধান সেই আন্তর্জাতিক আইনের অনুসরণ মাত্র।
কিন্তু শেখ হাসিনা দেশ শাসনের নামে ১৫ বছর যে নিষ্ঠুরতা করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সরকার আইন দিয়েও আমাদের গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করেছে। আইনের মাধ্যমে কণ্ঠ রোধ করলেই তা আইনসিদ্ধ হয়ে যায় না। ফলে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কালো আইনগুলো শিগগিরই বাতিল করার কথা উঠেছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতান্ত্রিক কাঠামোর অন্যতম সূচক। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মূলধারার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রধান অন্তরায়, যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। এই আইন তথ্য অধিকার আইনের সুফল লাভের ক্ষেত্রেও বড় বাঁধা। যেটা এখনো শুধুমাত্র ভোল পল্টিয়েছে বিগত সরকার। অধিকাংশ সাংবাদিকরা বলছেন,বাংলাদেশে প্রচলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি স্বাধীন মত প্রকাশে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। আইনটির কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মুক্ত গণমাধ্যম গণতান্ত্রিক সমাজের একটি স্তম্ভ। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে রয়েছে’–কথাগুলো বলেছেন জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিকাশ ও সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান। আসলেই দেশে দেশে স্বৈরাচারী শাসক ও এমনকি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসকরাও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে তৎপর। ক্ষমতাবানদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও তাদের অন্যায় কাজকে চ্যালেঞ্জ করাই গণতান্ত্রিক সাংবাদিকতা। সত্য প্রকাশে দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার না থাকলে গণতান্ত্রিক সাংবাদিকতার আশা করা যায় না। আমি মনে করে দিতে চায়, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের পত্রিকা-টেলিভিশনের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।
গবেষণার মাধ্যমে তুলে আনতে হবে কিভাবে সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র না থাকলেও বহিবিশ্বের কাছে বৈধ গণতন্ত্র দেখানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, এখন তো শুধু জুলাই-আগস্টের মৃত্যুর সংবাদ দেখি। ২০১২ সালে ইলিয়াস আলি ও ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গুমের সংবাদ গণমাধ্যমগুলো ঠিকমত প্রকাশ করেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকতায় সবার অবস্থান থাকতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে সাংবাদিকতা না করে, সব মতের সাংবাদিকতাকে সুযোগ দিতে হবে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমরা অনেকেই এই কাজে ব্যর্থ হয়েছি।
মালিকের জনসংযোগ কর্মকর্তার ভূমিকা পালন করে আমরা নিজেরাই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছি। আমরা অনেকেই আমাদের পদাধিকার ব্যবহার করে ধনী ও শক্তিমানদের কাছ থেকে অনুগ্রহ আদায় করেছি, প্রভাবের বিনিময়ে ব্যক্তিগত অর্জন পেয়েছি, নিজ অবস্থানের অপব্যবহার করে অন্যদের ক্ষতি করেছি এবং প্রকৃত সত্যটি জানা সত্ত্বেও সুবিধাজনক রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে থাকার জন্য তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছি।
৫ আগস্টের আগে অনেক মিডিয়া ছাত্রদের দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারী বলতো বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ১৫ বছর ধরে গণমাধ্যম কেবল সরকার ও রাষ্ট্রের দাসত্ব করেনি। গণমাধ্যমের মূল সমস্যা অসত্য বলতে বলতে মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আস্থা ফেরানোর পদ্ধতি একটাই—সত্য বলা। নিরেপেক্ষ সাংবাদিকতা করতে পারলে, জবাবদিহির জায়গা তৈরি করা গেলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিজম আসবে না। তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি জবাবদিহিমূলক সাংবাদিকতাও খুবই জরুরি। এ জবাবদিহি শুধু সরকারের কাছে নয়, জনগণের কাছে। সরকারের কাছে আছে আইনগত দায়বদ্ধতা। কিন্তু রাষ্ট্র তথা মানুষের কাছে আছে নৈতিক দায়বদ্ধতা, যেটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দল-মতের সমর্থন করা দোষের কিছু না।
কিন্তু দিন শেষে সাংবাদিক মানে সংবাদকর্মী, দলীয় কর্মী নয়। সাংবাদিকদের এই পরিচয়টাকে জনগণ খুব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে নিরেপেক্ষ সাংবাদিকদের সাংবাদিক পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশের ছাত্র জনতার প্রত্যাশা। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি-দুরাচার, অনাচার-অসঙ্গতি পাঠক-দর্শকের সামনে তুলে ধরাই সংবাদমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব তারা কতটা পালন করতে পারছেন সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
লেখক ও গবেষক :
আওঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব
লেখক ও গবেষক :
আওরঙ্গজেব কামাল
ঢাকা প্রেস ক্লাব