রনজিত কুমার পাল (বাবু):
তীর্থ ভ্রমন, তীর্থস্নান, দেব-দেবীর মন্দির বা বিগ্রহ, মহাপুরুষদের আশ্রম, তীর্থক্ষেত্র ইত্যাদি দর্শন ও অবগাহন হিন্দুদের অতি পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
সেই পুরাকাল থেকেই সনাতন ধর্মে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে তীর্থযাত্রা,তীর্থস্নান,তীর্থপরিক্রমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই কলিযুগেই শুধু নয় সত্য-ত্রেতা-দ্বাপরে ও তীর্থযাত্রা, তীর্থস্নান, মন্দির, মহাপুরুষ তথা বিভিন্ন বিগ্রহ দর্শন।
পূন্যকর্মোপক্ষে দূর-দূরান্তে গমনও ভ্রমনের অজস্র প্রামান পাওয়া যায়, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি নানা পৌরাণিক গ্রন্থেও কাহিনীতে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এমনি একটি অবগাহন তীর্থক্ষেত্র হলো লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র স্নান।
আসছে ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং (২রা বৈশাখ ১৪৩১ বাংলা ) রোজ সোমবার দুপুর ১২ টা ৪১ মিনিট হইতে ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং (৩রা বৈশাখ ১৪৩১ বাংলা) রোজ মঙ্গলবার দুপুর ০১টা ৫৩ মিনিট পর্যন্ত অষ্টমী তিথিতে মহাতীর্থ লাঙ্গনবন্দের অষ্টমী স্নান অনুষ্ঠিত হইবে।
ঐতিহাসিক মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ ব্রহ্মপুত্র স্নান এর অবস্হান- নারায়নগঞ্জের জেলা সদর থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর কোনে, বন্দর থনার অন্তর্গত ঢাকা মহানগরী থেকে একুশ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ কোনে এই তীর্থ স্থানটি বর্তমান মুছাপুর ইউনিয়ন আদি ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক (এশিয়ান হাইওয়ে) ব্রহ্মপুত্র (লাঙ্গলবন্দ) সেতুযোগে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর দিয়ে পশ্চিম পাশে সোনালী পেপার এন্ড পাল্প মিলস্ লিঃ-এর সম্মুখ থেকে দীর্ঘ দেড় কিলোমিটার এলাকা নিয়ে তদানানী ৭জন জমিদারের যৌথ সম্পত্তির উপর তীর্থস্থানটি অবস্থিত। দেশ-বিদেশের লক্ষাধিক পূর্ণার্থী ভক্তবৃন্দ ঐতিহাসিক মহাতীর্থ নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ স্নানোৎসবে অংশ গ্রহণ করবে।
ঐতিহাসিক মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ ব্রহ্মপুত্র স্নানোৎসব সমন্ধে জানা যায়,ত্রেতা যুগের প্রথম দিকে মগধদেশে ভাগীরথী নদীর কৌশিকী তীরে ভোজকোট নামক নগরীর অধিপতি ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজর্ষি গাধি। রাজর্ষি গাধির বিশ্বামিত্র নামে পরিচিত এক পুত্র ও সত্যবতী নামে সুন্দরী কন্যা ছিল। সত্যবতীর বিবাহ হয় ভৃগুমুনি নামে পরিচিত ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মন কুমার রিচিকের সাথে। সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক মুনির জম্ম হয়।জমদগ্নি বয়ঃ প্রাপ্ত হয়ে প্রসেনজিং রাজার কন্যা রেনুকাকে বিয়ে করেন। রেনুকার গর্ভে জমদগ্নির পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করেন কনিষ্ঠ সন্তান পরশুরাম ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। জম্মলগ্নে এই পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল রাম। ইনি কুঠার দ্বারা একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেন। কুঠার ধারণের জন্য তার নাম পরশুরাম (কুঠারধারী রাম) রূপে খ্যাত হয়।
ভৃগুবংশের সন্তান এজন্য তাকে ভার্গব এবং জমদগ্নির পুত্র বলে তাকে জামদগ্ন্য নামেও সম্বোধন করা হয়। একদিন জমদগ্নির পাচঁপুত্র ফল সংগ্রহার্থে বনে গেলে তাদের মাতা অমোঘাদেবী (রেনুকা) স্থানপূর্বক জল আনয়নের জন্য নিকটস্থ গঙ্গানদীতে যান। তিনি যখন নদীর ঘাটে জল আনতে যান তখন শতবাহু নামে এক রাজা তাঁর শত স্ত্রী সনে গঙ্গা নদীতে জলকেলি করছিলেন। রাজা তার শত বাহুতে নদীর জল আকর্ষন করলে অবলীলা ক্রমে স্ত্রীগন তাঁর বাহুর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেন হঠাৎ রাজা সমস্ত জল একবারে ছেড়ে দেন। স্ত্রীগন তীব্র স্রোতে ভেসে যেতে থাকলে রাজা পূর্নবার জল আকর্ষন করেন। এমত জলকেলি চলাকালে জমদগ্নি ঋষি -পতী অমোঘা দেবি (রেনুকা) নদীর ঘাটে গিয়ে শতবাহু রাজার কৌতুকপূর্ণ নয়নাভিরাম জলকেলি দর্শনে অন্তরে এক বিচিত্র পুলক অনুভব করেন।
কিছুক্ষণ এ দৃশ দর্শনান্তে জল নিয়ে ঘরে ফিরলে ঋষি জমদঘ্নির স্ত্রীর বিলম্ব ও শরীর রোমাঞ্চিত হবার কারন জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু অমোঘ দেবীকে নির্বাক থাকতে দেখে তিনি যোগবলে পতীর পূর্বাপর সকল ঘটনা অবগত হন। ঋষি জমদগ্নি এই বিধ মানসিক বিকৃতিতে ক্রোধান্ধিত হয়ে পরেন। রুঢ়স্বর কন্ঠে তৎক্ষণাৎ স্বীয় পূত্রদেরকে তাদের মাতাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠচার পুত্রই তাদের মাতাকে হত্যা করতে অস্বীকার করেন। পিতার আদেশ অমান্য করেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে চার পুত্রকে পশু পক্ষীর মত জড় ও হীনবুদ্ধি সম্পন্ন নিকৃষ্ট জীবন প্রাপ্তির অভিশাপ দেন।
সর্বশেষ তিনি তার পঞ্চম পুত্র পরশুরামকে মাতৃ হত্যার আদেশ দেন। পরশুরাম কম্পিত হৃদয়ে শঙ্কিত চিত্তে পিতৃ আদেশ সম্পন্ন করেন। পিতৃ আদেশ পালন করার আর্শীবাদ স্বরূপ জমদগ্নি ঋষি পুত্র পরশুরামকে বর চাইতে বললেন। অনুশোচনেয় দগ্ধ হৃদয়ে পরশুরাম আবেগাপ্লুত কণ্ঠে চাইলেন,
১. তপ:প্রভাবে আমাদের মা যে আবার জীবিত হয়ে আমাদের সাথে পুনরায় বসবাস করতে পারেন।
২. হত্যার ঘটনা যেন মায়ের স্মরনে না থাকে।
৩. চার জ্যেষ্ঠভ্রাতা যেন মনুষ্যবৎ পূর্বাবস্থা ফিরে পায় ৪. এই হত্যাকাণ্ডে তার যেন পাপস্পর্শ না হয়।
কিন্তু যেই মাত্র মাতার দেহ কুঠারে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে সেই মুহূর্তেই পরশুরাম মাতৃহত্যা ও নারী হত্যা জনিত দ্বিবিধ পাপে আক্রান্ত হলেন। পরশুরাম হতবাক! তার হাতের কুঠার যে তার হাতেই লেগে আছে। তিনি উদ্বিগ্নতাকুলচিত্তে জিজ্ঞেস করলেন, পিতা- আমিতো আদেশ মাত্র, তবে কেন কুঠার আমার হাতে লেগে আছে। পিতা বললেন, তুমি মাতৃ ও নারী হত্যা দ্বিবিধ পাপে আক্রান্ত হয়েছো। আর জেনে রাখ, পাপ ছোট-বড় যাই হোক না কেন, কৃতকর্মীকে তা স্পর্শ করবেই ১ঋষি পুত্রকে আশ্বস্ত করে ধৈর্য ধারন করেতে বললেন ।আর উদ্বিগ্ন না হয়ে অবিলম্বে সব তীর্থ ভ্রমনে ও স্নানে তোমার হাতের কুঠার স্খলিত হবে।
জানবে যে ঐ পূন্যস্থান ই পৃথিবীর সর্বোশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র। পিতৃআজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে পরশুরাম পৃথিবীর নানা তীর্থ পরিভ্রমণ করতে লাগলেন।
অবশেষে একদিন তিনি হিমালয় পর্বতের উত্তর পূর্ব কোনে মানস সরোবরের সন্নিকটে এক বৃহ্ৎ কূপ সমীপে উপনিত হলেন এবং পরমেশ্বরকে স্মরন করে পরশুরাম ব্রক্ষ্মকুন্ডে অবগাহন করলেন। অবগাহন করার সাথে সাথে তার হাতে লেগে থাকা কুঠার স্খলিত হয়ে গেল। পরশুরাম সর্ববিধ পাপ থেকে অব্যাহতি পেল।